এই ভাইরাসটি প্রথম চীনে ছড়াতে শুরু করলে, এটি বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ এবং দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য একটি বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। চীনের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) দ্রুত এই ভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। HMPV ভাইরাসটি মানবদেহে শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে প্রবেশ করে এবং এটি মূলত বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত ব্যক্তি যখন কাশে বা হাঁচি দেয়, তখন ভাইরাসটি বাতাসে মিশে যায় এবং তা অন্যদের শরীরে প্রবাহিত হতে পারে।
HMPV ভাইরাসের প্রকৃতি ও সংক্রমণ পথ
HMPV একটি RNA ভাইরাস, যা মূলত শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ সৃষ্টি করে। এটি একই গোত্রের একটি ভাইরাস, যা সাইনোসাইটিয়াল ভাইরাস (RSV) এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের রোগের কারণ হতে পারে। HMPV সাধারণত ঠান্ডা বা ভাইরাল ইনফেকশনের মতো লক্ষণ তৈরি করে, তবে এর প্রকৃতি কখনও কখনও গুরুতর শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে।
এই ভাইরাসটি মূলত শ্বাসতন্ত্রের রস (যেমন কাশি, হাঁচি, বা নিঃশ্বাস) এর মাধ্যমে ছড়ায়, এবং এটি আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। এছাড়া ভাইরাসটি আক্রান্ত পৃষ্ঠে থেকেও মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে, যেমন হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে ভাইরাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং যদি অন্য ব্যক্তি সেই বাতাসে শ্বাস নেয়, তবে তারও সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
লক্ষণ ও উপসর্গ
HMPV ভাইরাসের সংক্রমণের পর সাধারণত কিছু দিন পর লক্ষণগুলি প্রকাশ পায়। এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গগুলির মধ্যে রয়েছে:
- ঠান্ডা: সাধারণ সর্দি বা ঠান্ডা লাগার মতো উপসর্গ, যা নাক বন্ধ হওয়া, সর্দি বের হওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
- কাশি: ভাইরাসের কারণে শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ সৃষ্টি হলে, কাশি শুরু হতে পারে, যা সাধারণত শুকনো কাশি হয়ে থাকে।
- গলা ব্যথা: অনেক সময় ভাইরাসটি গলায় আক্রমণ করে, ফলে গলা ব্যথা বা শুষ্ক গলা অনুভূত হতে পারে।
- জ্বর: ভাইরাসটি শরীরে আক্রমণ করলে, শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে এবং জ্বর হতে পারে।
- শ্বাসকষ্ট: কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট হতে পারে, যা গুরুতর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
- দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি: ভাইরাসের কারণে শরীরে শক্তি হারানো এবং ক্লান্তির অনুভূতি হতে পারে।
কারণ এবং ঝুঁকি
HMPV ভাইরাসটি সাধারণত শিশুদের মধ্যে বেশি লক্ষণ প্রকাশ করে এবং একে শ্বাসতন্ত্রের রোগ হিসেবে খুবই গুরুতর হিসেবে দেখা যেতে পারে। ভাইরাসটি শিশুদের শরীরে আক্রান্ত হলে, তাদের শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা যেমন ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া সৃষ্টি করতে পারে। তবে, এটি প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে।
বিশেষত, যারা ইতিমধ্যে কোনো শ্বাসযন্ত্রের রোগে আক্রান্ত, যেমন হাঁপানি বা ব্রঙ্কাইটিস, তারা HMPV সংক্রমণের ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকিতে থাকে। এছাড়া, যাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, যেমন বয়স্ক ব্যক্তিরা বা যেসব ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তারা এই ভাইরাসের কারণে আরও গুরুতর অসুস্থতা বোধ করতে পারেন।
চীনে HMPV ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব
চীনে HMPV ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ভাইরাসের সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে এবং স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ দ্রুত পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে।
চীনে প্রাথমিক পর্যায়ে এই ভাইরাসটি সাধারণ সর্দি-কাশির মতো উপসর্গ সৃষ্টি করলেও, পরিস্থিতি অবনতির দিকে যেতে পারে, বিশেষ করে যদি শ্বাসতন্ত্রের গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, এবং ব্রঙ্কাইটিসের মতো গুরুতর শ্বাসযন্ত্রের রোগের ঝুঁকি থাকে, যা হাসপাতালজাত রোগীদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়।
প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা
HMPV ভাইরাসের কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, তবে চিকিৎসা শুধুমাত্র লক্ষণগুলির ওপর ভিত্তি করে হয়। ভাইরাসটি সাধারণত নিজেই সেরে যায় (Self limiting), তবে কিছু গুরুতর ক্ষেত্রে হাসপাতালে চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে। গুরুতর শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের অক্সিজেন সাপোর্ট এবং পর্যবেক্ষণ করা হয়।
চীনের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ভাইরাসটির বিস্তার রোধে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। জনগণকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে স্বাস্থ্যকর্মীরা গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। ভাইরাসের বিস্তার রোধে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ হাতে নেয়া কিছু মূল পদক্ষেপ হলো:
- বিশ্বস্ত স্বাস্থ্য তথ্য: জনগণকে ভাইরাসের লক্ষণ এবং সংক্রমণ কিভাবে ঘটে তা সম্পর্কে সচেতন করা।
- হাত ধোয়া: ভাইরাসটি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির শরীরে ছড়ানোর প্রধান উপায় হল স্পর্শ। তাই সঠিকভাবে হাত ধোয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- মাস্ক পরিধান: ভাইরাসটি বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়, তাই মাস্ক পরিধান করা উপকারী হতে পারে।
- সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা: ভাইরাসটি ছড়ানোর প্রধান মাধ্যম হল শ্বাসযন্ত্রের রস, তাই আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থেকে বিরত থাকা উচিত।
শেষ কথাঃ
চীনে HMPV ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব একটি গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করেছে, বিশেষত শিশু এবং দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য। ভাইরাসটির লক্ষণ সাধারণ সর্দি-কাশির মতো হলেও, এটি শ্বাসতন্ত্রের গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
তবে, সঠিক সচেতনতা, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এই ভাইরাসের প্রভাব কমানো সম্ভব। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং জনগণের মধ্যে একযোগ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে HMPV ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা যায় এবং মানুষের সুস্থতা নিশ্চিত করা যায়।
পাদটিকাঃ স্বাস্থ্য অধিদপ্তের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি